মিষ্টি

মিষ্টি
-টনি মরিসন

 

 

এতে আমার কী দোষ? আমার কিন্তু কোনো হাত ছিল না এতে। এমনটা যে হতে পারে স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার নাড়ি কেটে ওকে আলাদা করার ঘণ্টা খানেক পরে ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল আমার। কোথায় যেন একটা ভুল হয়ে গেছে…একটা সাংঘাতিক ভুল। ওর গায়ের রঙ দেখে আঁতকে উঠেছিলাম আমি…একেবারে কুচকুচে কালো…সুদানের ওই লোকগুলোর মতো। কিন্তু আমি তো দিব্যি ফরসা। আমার চুলও বেশ লম্বা সোজা…হলদেটে। লুলা অ্যানের বাপেরও তাই। আমাদের গুষ্টিসুদ্ধ কারো রঙই অমন কালো নয় বাপু। কালো তো কালো…একেবারে আলকাতরাকেও হার মানিয়ে দেয়। গায়ের রঙের সঙ্গে ঢেউ খেলানো সোজা চুলটা আরো বেমানান। অস্ট্রেলিয়ার ওই ন্যাংটো আদিবাসীগুলোর মাথাতেই দেখেছি অমন চুল। আপনারা হয়তো বলবেন বংশের ধারা। নিকুচি করেছে বংশের। এমনধারা কালো আর কে আছে আমাদের বংশে? আপনারা আমার দিদাকে তো আর দেখেননি। দিদাকে তো মোটামুটি ফরসাই বলা যায়। পরের বিয়েটাও এক সাদা মানুষেরই সঙ্গে। মানুষটাকে বিয়ে করে আগের ছেলেমেয়েদের বেমালুম গেছেন ভুলে। আমার মা-মাসিরা তাঁকে চিঠি লিখলে খামটা না খুলেই তিনি ফেরত পাঠিয়ে দিতেন। পুরোনো জীবনের সঙ্গে আর কোনো সংস্রব রাখতে চাননি তিনি। পরে মা-মাসিরাও হাল ছেড়ে দিয়েছে। দিদাকে আর বেশি ঘাঁটাতে যায়নি। তখনকার দিনে মুল্যাটো * আর কোয়াড্রুনদের* মাথায় লম্বা সাদা চুল থাকলেই নাকি কেল্লাফতে। তখন কেউ আর নিজেদের অর্ধেক কালো পরিচয়টা মনে রাখতে চায় না। নিজেদের সাদা ভেবেই ধন্য। কিন্তু কত সাদা চামড়ার নীচে যে কালো মানুষের রক্ত বইছে কে আর তার হিসেব রাখে! আমি শুনেছি এদের সংখ্যাটা নাকি শতকরা কুড়ি। আমার মা লুলা মে। তাঁকেও সাদা বলে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু মিথ্যে পরিচয়ের আড়ালে তিনি নিজেকে কখনো লুকোননি। এর জন্য অনেক ভুগতে হয়েছে তাঁকে। মূল্যও দিতে হয়েছে অনেক। বাবার হাত ধরে মা যখন কোর্টে গিয়েছিল বিয়ে করতে তখন ওখানে ওরা দেখেন দুটো বাইবেল। একটা সাদাদের, একটা কালোদের। কালোদের বাইবেলে হাত রেখে বিয়ের শপথ নিতে হয়েছিল তাঁদের। বাইবেল নিয়েও এমন আমরা-ওরা! উফফফ ভাবা যায়!
এক বড়লোক শ্বেতাঙ্গ দম্পতির বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন মা। আমার মায়ের হাতের রান্না তারিয়ে তারিয়ে খেতে তাঁদের আপত্তি ছিল না। বাথটাবে শুয়ে মাকে বলতেন পিঠে সাবান ঘষে দিতে। পিঠে সাবানঘষা থেকে আরো যে কত গা ঘষাঘষি হয়েছে ভগবান জানেন! কিন্তু কালো মানুষদের বাইবেলে হাত দিলেই নাকি ওদের জাত যায়!
এখানে রঙের আমি…রঙের তুমি… রঙ দিয়ে যায় চেনা। যে যত ফরসা সে নাকি তত ভালো। ক্লাবে, পাড়ায়, চার্চে এমনকী কালোদের স্কুলেও সেই একই নিয়ম। যার রঙ যত ফরসার দিকে সে নাকি তত ভালো। নিজেকে বাঁচাতে এই নিয়ম মানতেই হবে যে! নাহলে ওষু্ধের দোকানে তোমার মুখে লোকে থুথু দেবে…বাসস্টপে খামকা গুঁতো খাবে…সাদাদের রাস্তার পুরো ফুটপাথ ছেড়ে দিয়ে নর্দমার গা ঘেঁসে তোমায় হাঁটতে হবে…একটা ঠোঙার জন্য মুদি দোকানে তোমাকে বাড়তি পয়সা গুনতে হবে…অথচ সাদারা সেটা পেয়ে যাবে মুফতে। আরো কত যে খিস্তি খেউড় তোমাকে শুনে যেতে হবে সেগুলোর কথা আর নাই বা বললাম। আমি নিজের কানে সব শুনেছি। আমার মাকে তো মোটামুটি ফরসাই বলা যায়। ডিপার্টমেন্ট স্টোরের লেডিজ রুমে অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে মা…কাউন্টারে দাঁড়িয়ে দু-একটা টুপিও পরখ করে দেখতে পারে। কেউ আটকায় না। আবার জুতোর দোকানে সামনের কাউন্টারে বসেই জুতো টুতো পায়ে গলিয়ে দেখতে পারতেন আমার বাবা। কালো মানুষদের মতো তাঁকে পেছনের ঘরে যেতে হত না। তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে গেলেও ‘শুধুমাত্র কালোদের’ মদের দোকান থেকে কক্ষনো কোনো পানীয় ভুলেও কিনতেন না তাঁরা।
এ মেয়ের জন্ম থেকেই জ্বলে পুড়ে মরছি আমি। অন্য সব বাচ্চাদের মতো জন্মের সময় ওর গায়ের রঙ ছিল ফ্যাকাশে। জন্মের ঠিক পরে আফ্রিকান বাচ্চাদের গায়ের রঙও নাকি অমন ধারাই হয়।তারপর আমার চোখের সামনেই বদলে গেল সব…একেবারে নীলচে কালো। মাথাটা যেন বোঁ বোঁ করে ঘুরছিল আমার। এই বুঝি পাগল হয়ে যাব। মাথাটা আর কাজ করছিল না। বাচ্চার মাথা অবধি কম্বলটা টেনে হাত দিয়ে একেবারে চেপে ধরেছিলাম। না না শেষ পর্যন্ত করতে পারিনি। মেয়ের রঙ যতই বীভৎস কালো হোক না কেন মা হয়ে কি কেউ তা করতে পারে? মাঝে মাঝে মনে হত যাই ওকে কোনো অনাথাশ্রমে গিয়ে দিয়ে আসিগে, পারিনি। ওই যে মায়েরা তাদের বাচ্চাদের চার্চের সিঁড়িতে ফেলে আসে তাদের মতো হতে যে আমার দারুণ ঘেন্না। ওদের মতো কি আমি হতে পারি! এই তো কয়েকদিন আগে জার্মানির এক স্বামী-স্ত্রীর কথা শুনলাম। দুজনেই ধবধবে সাদা। আর তাদের বাচ্চার রং দেখে সবার চোখ কপালে। একেবারে ভূষো কালি। আবার কত যমজ বাচ্চার একজন সাদা, আরেকজন কালো। কিন্তু ব্যাপারটা কতটা সত্যি তা নিয়ে ধন্দ আছে আমার মনে। নিজের চোখে তো আর দেখিনি। কুচকুচে কালো বাচ্চাটাকে বুকের দুধ খাওয়াতে গা টা গুলিয়ে উঠছিল আমার। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেই ধরিয়ে দিলাম ফিডিং বটল।
আমার বর লুইস রেলের পরিচারক। রেলের ডিউটি থেকে ফিরে এসে এমন করে চাইল আমার পানে যেন ভস্ম করে দেবে। বাচ্চাটা বুঝি অন্য কোন গ্রহ থেকে এসে পড়েছে ভাবটা ওর এমন। আমার বর এমনিতে মুখ খারাপ করে না…কিন্তু সেদিন যখন ও চেঁচিয়ে বলল… ‘ হে ভগবান! এ আবার কাকে তুলে এনেছ!’ তখনই পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল আমার। সেই আমাদের সম্পর্কে ভাঙন শুরু। তারপর রাতদিন শুধু লড়াই আর ঝগড়া করতে করতে আমাদের বিয়েটাই গেল ভেঙে…একেবারের তাসের ঘরের মতো। আমাদের তিন বছরের বিবাহিত জীবন। কত আনন্দে…একে অপরের উষ্ণতায় কাটিয়েছি এই তিনটে বছর। বাচ্চাটাকে দেখে আমার দিকেই আঙুল তুলেছে লুইস। অভিযোগ করেছে বার বার। আর লুলা অ্যান তো ওর দু চক্ষের বিষ। কোনোদিন ছুঁয়েও দেখেনি মেয়েকে।
আমিও নিজের সতীত্বের পরীক্ষা দিতে যাইনি। কী হবে দিয়ে! আমি যে অন্য কোনো মানুষের সঙ্গে আশনাই করে বেড়াইনি সে ব্যাখ্যান ওকে দিতে যাইনি। ও কি আমায় বিশ্বাস করবে? ও তো ভাববে আমি মিথ্যে বলছি। তবে সেদিন ঝগড়ার সময় আর চুপ থাকতে পারিনি…আমিও গায়ের ঝাল মিটিয়ে নিয়েছি ‘ আমার গুষ্টিতে তো কেউ এমন কালো নেই…মেয়ে কালো কেন হয়েছে তা তুমি জানো…আর তোমার চোদ্দগুষ্টি জানে’। আমাদের তিক্ততা উঠল চরমে। একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গেল লুইস। মেয়েকে নিয়ে আমি একেবারে একা। আমার একার লড়াই শুরু। প্রথমে একটা সস্তার বাড়ি খোঁজা। বাড়ি খোঁজার সময় মেয়েকে সঙ্গে নিতাম না। বাড়িওলাদের চোখে পড়লেই মুশকিল। আমার এক তুতো বোনের কাছে বাচ্চাকে রেখে এখানে ওখানে বাড়ি খুঁজে বেড়াতাম। বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে বেরনো যায় না। আমি পেরাম্বুলেটর ঠেলে নিয়ে যাই। আমাকে দেখে উৎসাহী হয়ে অনেকেই বাচ্চাটাকে একটু ‘সোনা মনা’ করার জন্য উঁকি মারে। তারপর বাচ্চাকে এক নজর দেখেই নাক মুখ সিঁটিয়ে তাঁরা এক হাত দূরে। খুব খারাপ লাগে আমার। আমাদের রঙটা বদলাবদলি হয়ে গেলে আমাকে হয়তো এই বাচ্চারই আয়া হয়ে পেট চালাতে হত। কে জানে! সাদা ছাড়া অন্য কোনো মহিলার পক্ষে শহরের ভদ্রস্থ জায়গায় ঘর ভাড়া পাওয়া যে কী মুশকিল! তা সে গায়ের রঙ যতই হলদেটে হোক না কেন! নব্বইয়ের দশকে লুলা অ্যান জন্মাল। তখন অবশ্য অনেক আইন কানুন হয়ে গেছে। রঙ দেখে নাকি ভাড়াটদের বিচার করা যাবে না। সবাইকে বাড়ি ভাড়া দিতে হবে। তা বাড়িওয়ালারা সে কথা মানলে তো! সাদা ছাড়া অন্য কাউকে তারা ঘরই দেবে না। তবে মি. লেই অবশ্য ব্যতিক্রম। আমাকে ঘর দেওয়ার সময় ভাড়াটা বিজ্ঞপনের চেয়ে সাত ডলার বাড়িয়ে বললেন। ভাড়া দিতে একদিন দেরি হলেই চেঁচিয়ে মেচিয়ে একসা।
মেয়েকে মা ডাকতে শেখাইনি। ওকে বলেছি আমাকে ‘মিষ্টি’ বলে ডাকতে। এটাই সবদিক থেকে ভালো। একটা কালো কুচকুচে মোটা ঠোঁটওলা মেয়ে আমাকে ‘মা’ বলে ডাকলে সব লোকে বাঁকা চোখে তাকাবে। সে বড় বিচ্ছিরি। তারপর মেয়ের চোখ দুটোও ভারি অদ্ভুত। পিচকালো চোখে নীলের এক পোঁচে কেমন যেন পেত্নীর মতো লাগে ওকে দেখতে।
মা-মেয়ে দুজনের সংসার। একা একটা মেয়ে…তার ওপর স্বামী ছেড়ে চলে গেছে …কী কষ্ট করে যে তাকে সংসারের জোয়াল টানতে হয় তা আর কে বোঝে! আমার মনে হয় লুইসেরও পরে একটু অনুশোচনা হয়েছিল। কয়েক মাস পরে আমার নতুন বাড়ির ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার পর আমায় মাসে মাসে টাকা পাঠাতে শুরু করে। আমি ওর কাছ থেকে খোরপোষ চাইনি। এ নিয়ে আইন আদালতও করিনি। তবে প্রতি মাসে ওর পঞ্চাশ ডলারের মানি অর্ডারটা পেয়ে আমার যে কী উপকার হয়েছিল! রাতে হাসপাতালের চাকরি আর লুইসের পাঠানো পঞ্চাশ ডলার। আমাদের মা-মেয়ের পক্ষে যথেষ্ট। সরকারি সাহায্য আর নিতে হত না। জিনিসটা বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাদের। আমার মা যখন ছোট ছিল তখন একে ‘সরকারি সাহায্য’ না বলে, বলা হত ‘ত্রাণ’। আমার মতে সেটাই শোনায় ভালো। যতদিন না তোমার করেকম্মে নিতে পারছ ততদিন সরকার দেখভাল করবে তোমার। সরকারি সাহায্যের এই টাকা বিলির করার জন্য যে কেরানিরা বসে থাকে তাদের মতো জঘন্য মানুষ আর জীবনে দেখিনি আমি। হাসপাতালের কাজটা পাওয়ার পরে ওদের চেয়ে ঢের বেশি কামাতাম আমি। ওরা আমাদের ভিখিরি ঠাওরেছিল। টাকা বের করতে যেন প্রাণ ফেটে যায় ওদের। তাও করুণা করে দু-দশ টাকার চেক ঠেকিয়ে আমাদের যেন কেনার গোলাম বানিয়ে নিত। তারওপর আমার বেলায় তো ওদের আরো বেশি কড়াকড়ি। লুলা অ্যানকে দেখে আমার দিকে যখন তাকাত ওদের চোখে মুখে ফুটে ওঠা সেই অবিশ্বাস আমি জীবনে ভুলবো না…যেন আমি ঠকিয়ে টাকা আদায় করে নিচ্ছি ওদের কাছ থেকে।
আমাদের অবস্থা ফিরেছে। কিন্তু আমি খুব চোখে চোখে রেখেছি মেয়েকে। এক চুলও এদিক থেকে ওদিক হতে দিইনি। ভীষণ কড়া শাসনে রাখতে হয়েছে মেয়েকে। বরাবর। আমি ওকে বলেছি রাস্তায় সবসময় মাথা নীচু করে হাঁটবে। বাইরে বেরিয়ে কোনো ঝুট-ঝামেলা করবে না। এরজন্য ওকে কতবার নাম বদলাতে হবে সে নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল নেই। আমি শুধু জানি ওর এই মিশকালো রঙের বোঝাটা ওকে সারাটা জীবন ক্রুশের মতো বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। কোনো রেহাই নেই। কিন্তু এতে আমার কী দোষ! আমার কোনো দোষ ছিলনা এতে! কিচ্ছু না!
এখন ভাবলে খুব খারাপ লাগে। ছোটবেলায় ওকে কত না বকাঝকা করেছি। কিন্তু আমারও যে কিছু করার ছিল না। আমারও যে হাত পা বাঁধা। ওকে যে আমায় আগলে আগলে রাখতে হত। দুনিয়াদারির কী বোঝে ও? তার ওপর ওই তো গায়ের রঙ। এই রঙ নিয়ে কি ও সমাজে কোনোদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে? পড়ে পড়ে মারই খাবে শুধু। কোনো দোষ না করেও মাথা নীচু করে ঘুরতে হবে তোমায়। শুধু এই গায়ের রঙের জন্য। স্কুলে একটু ঝগড়াঝাঁটি কি মারামারি করলেই ওরা তোমাকে পাঠিয়ে দেবে জুভেনাইল লকআপে। এই গায়ের রঙ নিয়ে তোমার চাকরি জুটবে সবার শেষে আর ছাঁটাই হবে সবার আগে। ও তো আর নিজে বুঝতে পারে না ওকে দেখলেই আশেপাশের লোকজন কেমন ঘেন্নায় কুঁকড়ে যায়। অনেকে আবার গলা ফাটিয়ে হাসে। তার ওপর কালো দেখলেই কত রকম মস্করা করে লোকে। ওই যে ওই মেয়েটাকে যেমন করেছিল। মেয়েটার গায়ের রঙ লুলা অ্যানের মতোই। কতই বা বয়স হবে মেয়েটার। বড়জোর দশ। একদল সাদা ছেলে ওকে ঘিরে ধরে এক পায়ে মারল এক ল্যাং। হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে যেই না মেয়েটা একটু সামলে নিল অমনি পেছন থেকে একটা ছেলে মারল এক লাথি। টাল সামলাতে না পেরে মেয়েটা এবার চিৎ পটাং। ছেলেগুলোর মুখে সে যে কী বীভৎস হাসি! হাসতে ওদের হাসতে পেট ফেটে যাওয়ার জোগাড়। মেয়েটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে যাওয়ার পরেও হাসি আর তাদের থামেনা…যেন কী সাংঘাতিক বীরত্বের কাজ করে ফেলেছে একটা। আমি ছিলাম বাসে। জানালা দিয়ে এই দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিলাম আমি। বাসে না থাকলে মেয়েটাকে হয়তো একটু সাহায্য করতে পারতাম। ওই সাদা ছোঁড়াগুলোর খপ্পর থেকে মেয়েটাকে উদ্ধার করতে হয়তো পারতাম। ভাগ্যিস লুলা অ্যানকে সবকিছু শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছিলাম। তা নাহলে সাদা ছেলেদের নজর এড়িয়ে ও রাস্তা পার হতে পারত না। আমি ওকে যা শিখিয়েছিলাম জীবনে সেটা ওর সত্যিই কাজে লেগেছে। ওর জন্য আমার গর্ব হয়।
মা হিসেবে মোটেই খারাপ ছিলাম না আমি…মানতেই হবে। তাও একমাত্র মেয়েকে কত শাসন করেছি। আমি আর কীইবা করতে পারতাম! ওকে যে আমায় আগলে রাখতে হত। আমাকে যে এই শাসনটুকু করতেই হত। আর কোনো উপায় ছিল না আমার। যত নষ্টের গোড়া তো ওই গায়ের রঙ। প্রথম প্রথম ওই কালো চামড়ার ভেতরকার মানুষটাকে আমি আপন করে নিতে পারিনি। কিন্তু এখন পারি। এখন সত্যিই পারি। মেয়েও হয়তো এখন মাকে বুঝতে পারে। আমার তো তাই মনে হয়।
গত দুবার মেয়েকে দেখে চমকে উঠেছি আমি। সে তখন তেজি ঘোড়ার মতো…আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে মাঝে মাঝে। ওর গায়ের রংটা এখন আর তেমন করে চোখে লাগে না। বাহারি সাদা জামা কাপড়ে ওকে বেশ ঝলমলে আর খোলতাই লাগে।
মেয়ের কাছ থেকে খুব বড় একটা শিক্ষা পেয়ে গেছি আমি। এটা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। বাচ্চাদের সঙ্গে তুমি যেমন আচরণ করবে সেটাই পরে ফেরত পাবে। বাচ্চারা কোনো কথা ভোলে না। সুযোগ পেয়েই আমাকে ছেড়ে চলে গেল মেয়ে। এই নির্জন ফ্ল্যাটে ভূতের মতো পড়ে রইলাম আমি একা। ক্যালিফোর্নিয়ায় মেয়ে এখন খুব বড় চাকরি করে। মায়ের কাছে আসার সুযোগ বিশেষ হয় না। ফোন টোনও করে না। হ্যাঁ মাকে অবশ্য টাকা পাঠায় নিয়ম করে। যখন যেমন সম্ভব। কতদিন যে মেয়ের মুখটা দেখিনা!
উইনস্টন হাউসের এই ছোট্ট ঘরোয়া ফ্ল্যাটেই ভালো আছি আমি। এখানেই আমার শান্তি। শহরের বাইরে ওই বড় ঝাঁ চকচকে ওল্ড এজ হোম টোমে যেতে চাই না। ওতে অনেক খরচ। সেই তুলনায় আমার ফ্ল্যাট অনেক সস্তা। এখানে নিজের মতো থাকতে পারি আমি। আর তাছাড়া এখানে চব্বিশ ঘণ্টার আয়া তো রয়েছেই। তারপর সপ্তাহে দুদিন ডাক্তার এসে দেখে যান। বয়স তো এমন কিছু হয়নি আমার। মাত্র তেষট্টি। এই বয়সেই হাড়ের ব্যামোয় প্রায় পঙ্গু। এই অবস্থায় যত্নের খুব প্রয়োজন। শরীরের ব্যথা বেদনা… তার ওপর নিঃসঙ্গতার এই অসহ্য যন্ত্রণা! আমার আয়ারা অবশ্য খুব ভালো। ওরা খুব যত্ন করে আমার। ওদের একজনের কাছেই খবরটা ফাঁস করেছিলাম আমি… ‘আমি দিদা হচ্ছি’। সেই শুনে আনন্দের চোটে সে বেটি তো আমাকে গালে একটা চুমুই দিয়ে ফেলল। তার আনন্দ আর ধরে না। ওর লাফালাফি দেখে মনে হচ্ছিল দিদা নয়, আমি যেন রানিই হয়ে যাব। নীল কাগজে লেখা মেয়ের চিঠিটা দেখালাম ওকে। মেয়ে চিঠির নীচে সই করেছে ‘ব্রাইড’। ওসবে আমি কোনোদিন পাত্তা দিইনা। কিন্তু ওর চিঠির কথাগুলো পড়ে কেমন যেন খাপছাড়া লাগল… ‘ আমি তোমাকে একটা দারুণ খুশির খবর দেব। তুমি কি আন্দাজ করতে পারছ? আমি মা হচ্ছি। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে…তোমারও নিশ্চয়ই হচ্ছে’। বাচ্চাটাকে নিয়েই আমার যত আনন্দ…বাচ্চার বাবাকে নিয়ে নয়। হবে কী করে? বাচ্চার বাবার কথাতো কিছু লেখেইনি মেয়ে। আচ্ছা সেও কি আমার মেয়ের মতো কালো? হলে তো একদিক থেকে ভালো। যে উদ্বেগ আর যন্ত্রণা আমাকে পোয়াতে হয়েছিল আমার মেয়েকে তা হবে না। অবস্থা এখন অনেক বদলে গেছে। আমাদের যুগ আর নেই। টিভি, ফ্যাশন ম্যাগাজিন, বিজ্ঞাপণ এমনকি সিনেমাতেও সব নীলচে কালোরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
খামে মেয়ের কোনো ঠিকানা দেওয়া নেই। খারাপ মা হওয়ার শাস্তি দিচ্ছে মেয়ে। চোখ না বোজা অবধি আমায় পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে হবে। আমি জানি মেয়ে আমাকে ঘেন্না করে। মা-মেয়ের সম্পর্ক আজ এসে দাঁড়িয়েছে শুধু টাকাপয়সায়। মেয়ের পাঠানো টাকাটা আমার কাজেই লাগে…সেটা অবশ্য অস্বীকার করতে পারিনা। অন্য রুগীদের মতো আয়াদের কাছে আমার হাত পাততে হয়না। যখন ইচ্ছে তখন নতুন তাসের প্যাকেট কিনে ফেলতে পারি। ওই ছেঁড়াখোড়া ময়লা তাস পেটাতে হয় না আমায়। দামি ফেস ক্রিমের যে বিলাসিতাটুকু আমি করি সে তো ওই টাকারই জোরে। তবে যার যাই হোক আমি তো আর বোকা নই। মেয়ে মায়ের কাছে আসতে পারে না…আসতে চায়না…তাই টাকা পাঠিয়েই দায়িত্ব সারে। বিবেকের দংশনও আর থাকে না।
আমাকে খুব খিটখিটে, অকৃতজ্ঞ মনে হচ্ছে তাই না! আসলে অনুতাপের জ্বালায় দগ্ধে দগ্ধে মরছি আমি। জীবনে কত যে ছোট ছোট ভুল করে বসে আছি। যা করা আমার উচিত ছিল তা তো করিনি। মেয়ের যখন প্রথম মাসিক হল তখন কেমন রাগারাগি করেছিলাম আমি! তারপর মেয়ে হোঁচট খেয়ে পড়লে…হাত থেকে কোনো জিনিস ফেললে কত যে বকাবকি করেছি। ওর রংটা যে সহ্য হত না আমার…ওকে দেখলেই খিটখিটে হয়ে পড়তাম আমি। জন্মের পর ওকে যখন প্রথম দেখি তখন তো ভেবেই নিয়েছিলাম যে…না না ওসব কথা আর ভাবতে চাই না। কী হবে মন খুঁড়ে বেদনা জাগিয়ে। ওই অবস্থায় আমার পক্ষে যা যা করা সম্ভব ছিল সব করেছি। বর ছেড়ে চলে গেছে…একা একটা মেয়েমানুষ…এ অবস্থায় মেয়েকে একটা বোঝা ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি আমার। যে যাই বলুক এই বোঝা আমি খুব ভালোভাবেই বয়েছি।
হ্যাঁ, ওর ওপর খুব কড়াকড়ি করেছি আমি। আমি তো মেনে নিচ্ছি। ও যখন বারো পুরে তেরোয় পড়ল তখন আমাকে আরো বেশি করে শাসন করতে হয়েছে বইকি! মেয়েটাও তখন কী অবাধ্যই না হয়ে উঠেছিল। আমি যা রান্না করব তা খাবে না, মুখে মুখে চোপা। তারপর চুলের ফ্যাশন। আমি যত্ন করে বেনী বেঁধে দিতাম। মেয়ে স্কুলে গিয়ে খুলে ফেলত। ও বিগড়ে যাবে সেটা আমি কী করে সহ্য করব। ওর ওপর আমি চেঁচাতাম খুব… ‘ যা ইচ্ছে তাই কর…তারপর লোকেরা যখন এই নামে ডাকবে ওই নামে ডাকবে তখন বুঝবি ঠেলা’। তবে আমার শিক্ষা কিছুটা হলেও তো কাজে দিয়েছে। আজ কত বড় চাকরি করে আমার মেয়ে। কত উজ্জ্বল কেরিয়ার ওর। হাতে ওর কত টাকাপয়সা। আপনারা কি কেউ অস্বীকার করতে পারেন?
আজ মা হবে আমার মেয়ে। ভালো একটা চাল দিয়েছ লুলা অ্যান। তবে তুমি যদি ভাব মা হওয়া মানেই ঘুম পাড়ানি গান আর ন্যাপি বদলানো তাহলে কিন্তু খুব ভুল ভেবেছ। তুমি আর তোমার ওই নাম গোত্রহীন প্রেমিক… স্বামী…শয্যাসঙ্গী যাই বল না কেন… তোমরা শুধু ভাব… মা হওয়া মানেই বুঝি শুধু… ‘আমার সোনা…চাঁদের কণা’!
আমার কথা শোনো লুলা অ্যান। মা হওয়া মুখের কথা নয়। আর কদিন পরেই টের পাবে হাড়ে হাড়ে। বাবা-মা হলে দুনিয়াটা কীভাবে বদলে যায় তাও বুঝতে পারবে। বুঝবে কত ধানে কত চাল! আমার শুভেচ্ছা রইল। বাচ্চাটার মঙ্গল কর ভগবান!

 

• সাদা আর কালো মানুষের বর্ণ সংকর।

অনুবাদ— বর্ণালী জানা সেন

লেখিকা সম্পর্কে—আমেরিকার কালো মানুষের জীবনের রূপকার তিনি। তাঁর কাব্যময় ভাষায় সমাজের প্রান্তিক কালো মানুষদের চাওয়া-পাওয়া, সুখ-দুঃখের কথা তিনি তুলে ধরেছেন। জন্ম আমেরিকার ওহিও প্রদেশের লোরেন-এ, ১৯৩১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি।
মূলত উপন্যাসই লিখেছেন তিনি। প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। তারপর একে একে প্রকাশিত হয়েছে ‘সুলা’ ( ১৯৭৩), ‘ সং অফ সলোমন’ ( ১৯৭৭), ‘ টার বেবি’ ( ১৯৮১), ‘ বিলাভেড’ ( ১৯৮৭), ‘ জ্যাজ’ ( ১৯৯২), ‘ লাভ’ ( ২০০৩), ‘ আ মার্সি’ ( ২০০৮), ‘ হোম’ ( ২০১২)’ , ‘ গড হেল্প দ্য চাইল্ড’ (২০১৫)। ‘ বিলাভেড’ উপন্যাসটির জন্য পেয়েছেন পুলিৎজার প্রাইজ। সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে।

‘ মিষ্টি’ গল্পটি তাঁর ‘সুইটনেস’ গল্পের অনুবাদ। ‘নিউইয়র্কার’ পত্রিকায় গল্পটি প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি।

Loading

Leave A Comment